প্রতিদিনের স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগ্রামী নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর মৃত্যুর ৭৯ বছর পূর্তি হয়েছে আজ রোববার (১৮ আগস্ট)। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে তার দাহকৃত দেহাবশেষ তাইওয়ান থেকে টোকিওতে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে আজ পর্যন্ত পড়ে আছে তার পবিত্র দেহাবশেষ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরপর জটিল এবং অপ্রত্যাশিত অবস্থায় পড়ে যায় বৈশ্বিক পরিস্থিতি। মিত্রবাহিনী দখলে নেয় পরাজিত জাপানকে। সেইসঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে তখনও মুক্তি পায়নি ভারত। এ অবস্থায় তার দেহাবশেষ হস্তান্তর করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে ওঠে। এতে করে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের কর্মকর্তারা দেহাবশেষ ভারতে আনার বিষয়টি স্থগিত করেছিলেন।
১৯৫২ সালে জাপান সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়। এসময় ভারত একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে এগিয়ে চলেছে। এ পর্যায়ে দুই দেশের মধ্যে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। এরপর, পার্লামেন্টে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু নেতাজির দেহাবশেষ ভারতে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে বোসের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) একজন শীর্ষ কর্মকর্তা শাহ নওয়াজ খানের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু এবং টোকিওর বৌদ্ধ রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত দেহাবশেষের সত্যতা প্রমাণিত হয়।
কিন্তু বোসের রাজনৈতিক মতাদর্শের একটি অংশ যারা নেহেরুবিরোধী এবং অতি ডানপন্থী ছিলেন (১৯৩৯ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আওতাভুক্ত দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বোস নিজেই) তারা প্রধানমন্ত্রীর এমন পদক্ষেপে সন্দিহান ছিলেন এবং তা স্থগিত করে দেন।
ঠিক একই কারণে ১৯৯৫ সালে তারা তখনকার প্রধানমন্ত্রী পি.ভি. নরসিমা রাওকে দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনতে বাধা দেন।
এরপর তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও নেতাজির বোসের মৃত্যুর বিষয়টি পাঞ্জাব হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি জিডি খোসলার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলে যায় ১৯৫৬ সালের প্রতিবেদনটি।
বোসের দেহাবশেষে শ্রদ্ধা জানাতে বিজেপির নেতৃত্বাধীন অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০১ সালে রেনকোজিতে গিয়েছিলেন । তবে এক বছর আগে রহস্যময়ী এই মৃত্যুর বিষয়ে আরেকটি তদন্তের ঘোষণা দিয়ে তার দলের জোট সহযোগীদের সমালোচনা এবং চাপের মুখে পড়েছিলেন বাজপেয়ী।
এদিকে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে দাবি জানিয়েছেন তার নাতি চন্দ্র কুমার বসু। তিনি অনুরোধ করেছেন যে, জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রাখা নেতাজির দেহাবশেষ চলতি বছরের ১৮ আগস্টের মধ্যে ভারতে ফিরিয়ে আনা হোক। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই বিষয়ে একটি বিবৃতি জারি করার দাবী জানান, যাতে নেতাজির মৃত্যুর বিষয়ে চলমান রহস্য এবং মিথ্যাচারের যেন অবসান হয়।
তার নাতি বলেন, মোদির এনডিএ সরকার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ নথিগুলো প্রকাশ্যে এনেছে। সমস্ত জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ১০ টি তদন্তের পরে, এটি স্পষ্ট যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় মারা যান।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআইকে দেয়া সাক্ষাত্কারে চন্দ্র কুমার বোস আরও বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদিকে একটি চিঠি লিখেছেন এবং নেতাজির দেহাবশেষ ফিরিয়ে আনার দাবি জানান।
তিনি দাবি করেন, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু স্বাধীনতার পর তার দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তবে উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় মারা যাওয়ায় তিনি ফিরতে পারেননি। এ বিষয়ে আক্ষেপ করে চন্দ্র কুমার বসু বলেন, এটা খুবই অপমানজনক যে নেতাজির দেহাবশেষ এখনও রেনকোজি মন্দিরে রাখা হয়েছে। তিনি গত সাড়ে তিন বছর ধরে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে আসছেন যে নেতাজির দেহাবশেষ ভারতে আনা হোক।
তিনি বলেন, নেতাজির কন্যা অনিতা বোস হিন্দু রীতি মেনে নেতাজির শেষকৃত্য করতে চান, কিন্তু নেতাজির দেহাবশেষ জাপানের রেনকোজি মন্দিরে থাকায় তিনি শেষকৃত্য করতে পারছেন না। চন্দ্র কুমার বসু বলেন, যে ভারত সরকার যদি মনে করে যে রেনকোজি মন্দিরে রাখা দেহাবশেষগুলো নেতাজির নয়, তবে এই বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি পরিষ্কার করা উচিত এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত নয়। এই বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আশা করছেন।
তিনি জানান, কয়েকদিন আগে তার পরিবারের সদস্যরা রেনকোজি মন্দিরে যান এবং সেখানে প্রধান পুরোহিতের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেছেন যে নেতাজি ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। তাই তার মরদেহ স্বাধীন ভারতের মাটিতে আনতেই হবে। তার দেহাবশেষ দিল্লিতে আনা উচিত এবং তাকে শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা উচিত।
তিনি বলেন, এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে প্রধানমন্ত্রী মোদি এখনও তার চিঠির জবাব দেননি। ১৯৪৫ সালের আগস্টে জাপানের আত্মসমর্পণের পরে তাইওয়ান থেকে জাপানি সামরিক বিমান দিয়ে নেতাজিকে সরিয়ে নেয়াকে অনেকে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচার পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন। দুর্ঘটনায় নেতাজির ভাই শরদ চন্দ্র বসু এবং নেতাজির স্ত্রী এমিলি ১৮ বছর বয়সে নিহত হন। ১৯৪৫ সালের আগস্টের পর সুভাষ চন্দ্র বসুর বেঁচে থাকার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, বিচারপতি মনোজ মুখার্জি তদন্ত কমিশন ২০০৫ সালের প্রতিবেদনে দাবি করেন নেতাজি উল্লিখিত বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। এই তদন্ত প্রতিবেদনটিকে ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে ভারত সরকার তা নাকচ করে দেয়। এ সংক্রান্ত ১৮ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়ারে প্রকাশিত আশিষ রয়ের নিবন্ধটি বিস্তারিত পড়তে এখানে ক্লিক করুন।