প্রতিদিনের স্বদেশ ডেস্ক:
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালুর বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজিত ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই?’ শীর্ষক সেমিনারে অংশ নিয়ে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা মতামত ব্যক্ত করেন।
আরএফইডির সভাপতি একরামুল হক সায়েমের সভাপতিত্বে সেমিনারে বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নয়, রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ছাত্ররা রক্ত দিয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। আমরা যদি পরিবর্তন করতে না পারি, তাহলে এই রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের যে ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে, অনেক জায়গায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে; সেটাকে দাঁড় করানো। এটা চাট্টিখানি কথা নয়।
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে উপদেষ্টা বলেন, ‘সংস্কারের যে আলাপ হচ্ছে, সেগুলো আমার বিশ্বাস তারাও ধারণ করবেন। তবে দু-একটি জায়গায়, যেগুলো আমরা সবাই দেখেছি, এগুলো শোধরাতে সময় লাগবে। আমি প্রত্যেককে ওতপ্রোতভাবে এর সঙ্গে জড়িত থাকার আহ্বান জানাই। দেশ পরিচালনা রাজনীতিবিদরাই করবেন– আজ হোক, কাল হোক। কাজেই দায়দায়িত্ব নেওয়া তাদের আজ থেকেই শুরু করতে হবে।’
১৯৯১ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক ঐকমত্য ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরপেক্ষতা, সততা, পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রস্তাব দেওয়া হবে যাতে এত প্রাণের রক্তের সঙ্গে কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করা না হয়। নির্বাচন কমিশন নিয়োগের এখতিয়ার সংস্কার কমিশনের নয়। কমিশন শুধু সুপারিশ করবে, যাতে সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, রাষ্ট্র ও সরকারকে একাকার করলে যে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়, সেটাই হয়েছে বাংলাদেশে। ঐকমত্য শব্দটা অনেকটা আপেক্ষিক দাবি করে তিনি বলেন, বিএনপির ওপরে অনেক দায়িত্ব। সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি অভিভাবকের পরিচয় দিয়েছে। নির্বাচিত হলেও পরে অন্যান্য দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলেছে। বর্তমান সংবিধানের অনেক জায়গায় কিছু কিছু নতুন বিষয় সংযুক্ত করা দরকার।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ২০১৪ সালে চুইংগামের মতো কাস্টিং বাড়িয়ে ভোট দেখানো হয়েছে ৪০ শতাংশ। সরকারের ইচ্ছায় নির্বাচন প্রভাবিত হয়েছে। একটা ভোটে কত শতাংশ এমপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবে– সেই প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে ফের ভোট করতে হবে। সংবিধানে ৪৮ অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের প্রয়োজন– এ মন্তব্য করে জাপার এই সাবেক এমপি বলেন, আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা হলেও সবার অংশগ্রহণ থাকবে। ছোট ছোট দল ক্ষমতায় আসতে পারবে।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, সরকার না চাইলে পাঁচজন ফেরেশতা এনে বসিয়ে দিলেও নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না। সংস্কার কমিশনের সামনে অগ্নি পরীক্ষা। নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নে রাজনৈতিক ঐকমত্যে আসা সম্ভব হয়নি। দলগুলোর প্রতি একধরনের অনাস্থা এসেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই জায়গায় যায়নি যে, দলীয় সরকারের অধীনে তারা সুষ্ঠু ভোট করবে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখাই জরুরি। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতার অভাব আছে। দলগুলো যখন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায়, তখন তারা করতে পারে। আগামী তিন থেকে পাঁচটি জাতীয় নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হতে হবে– এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, আইন করার সঙ্গে মানসিকতার বদল হয় না।
এবি (আমার বাংলাদেশ) পার্টি সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আইনি যে কাঠামো আছে এগুলো ব্যবহার করে স্বচ্ছ নির্বাচন করা যায়। সংস্কারের চেয়ে কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি রাখতে হয়। প্রার্থীরা পছন্দের ডিসি-এসপি নেওয়ার জন্য তদবির করেন। কেন্দ্রভিত্তিক দখলদারিত্ব ও ডামি প্রার্থী দেওয়া এগুলো কারচুপির নির্বাচনের ছোট ছোট পয়েন্ট।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এই সেমিনারে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধির উপস্থিতির প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, তারা ফ্যাসিবাদের দোসর। তিনি বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রশাসনে নিরপেক্ষ লোক প্রয়োজন। ছাত্ররা যদি ডিসি-এসপি নিয়োগ দেয়, তাহলে তো ভয়ংকর ব্যাপার। সংবিধান বাতিল করে নতুন সংবিধান রচনা করতে হবে উল্লেখ করে নুর বলেন, স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয় করতে হবে। সংখ্যানুপাতিক ভোট পদ্ধতির পক্ষে মত দেন তিনি। আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর মুক্তির কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলে গ্রেপ্তার কেন করা হলো। ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালকে সরকার গ্রেপ্তার করতে পারেনি অথচ ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনে জামায়াত-বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হচ্ছে। সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমান সংবিধান বাতিল করে সংস্করণের সুপারিশ করেন তিনি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান আদিব বলেন, আগামী নির্বাচন দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দলগুলো গণহত্যাকারীদের বিচারের চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিদ্যমান সংবিধান বা প্রচলিত ব্যবস্থায় ভোট হলে যেই ক্ষমতায় আসুক, তারা ফ্যাসিবাদী দানবে রূপান্তরিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত সংখ্যানুপাতিক ভোট নিয়ে যেভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তরুণরা কী চাচ্ছে, তা নিয়ে দলগুলোকে গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং তরুণদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে।