প্রতিদিনের স্বদেশ ডেস্ক:
ডেঙ্গু আমাদের জন্য একটি অভিশাপ। বাংলাদেশে ডেঙ্গু কোন নতুন রোগ নয়, এটি বাংলাদেশে ষাটের দশকে প্রথম দেখা দিয়েছিল, তবে মাঝে এর বিস্তার প্রায় বন্ধ ছিল। ২০০০ সালে পুনরায় আবার এর বিস্তার শুরু হয় এবং অধ্যাবধি দুই যুগ ধরে চলমান রয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রমশই এর ভয়াবহতা বাড়ছে। এবছরও ইতিমধ্যে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আমাদের চোখ রাঙ্গাচ্ছে।২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুতে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর রেকর্ড সংরক্ষণ করে আসছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর থেকে ২০২৩ সালে রেকর্ড ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ওই বছর এ রোগে মারা গেছেন সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭০৫ জন। চলতি বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৪৬১ জনে। তাদের মধ্যে মারা গেছেন মোট ২৩৭ জন। বিগত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ক্রমেই বাড়ছে।ডেঙ্গু চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করাই উত্তম। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ডেঙ্গুর চিকিৎসা সমাজের পিছিয়ে পড়া নিম্নআয়ের মানুষের জন্য অত্যন্ত কঠিন ও ব্যয়বহুল। মশাবাহিত এই রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার, সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য সরকারী-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন, যার মধ্যে রয়েছে সচেতনতা তৈরিতে ক্যাম্পেইন, মশার বংশবিস্তারের স্থান নির্মূল ও মশার লার্ভা নিধন। ডেঙ্গুর বাহক মশা এডিস নির্মূলে রাস্তায় স্প্রে-ম্যান কীটনাশক স্প্রে করলেই ডেঙ্গু নির্মূল হবে না- কারণ, এডিস মশা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘরবাড়ির ছাদ ও বারান্দায়, স্কুল কলেজ ও অফিস অফিসের আঙ্গিনায় সাধারণত ২ মিলি লিটার বা তার কিছু বেশি পানি পেলেই বংশবৃদ্ধি করতে পারে। গাছের গোঁড়ায়, প্লাস্টিকের ভাঙা বাটিতে, ফেলে দেওয়া নানা জিনিসে অনেক সময় পানি জমে থাকে, যাতে এডিস মশা ডিম পাড়ে। কাজেই প্রত্যেক নাগরিককে যার যার ঘর বাড়ি, বাড়ির ছাদ, বারান্দা, স্কুল কলেজ, অফিসের আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখতে হবে, স্প্রে ম্যান কিন্তু এসব জায়গায় এসে কীটনাশক স্প্রে করে না। তাই এ রোগ প্রতিরোধে সমাজের সকল স্তরের নাগরিককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে এডিস মশা দেয়ালে না বসে সাধারণত সোফায়, টেবিলে, জানালার পর্দায় ও বেডসিটের ঝুলন্ত অংশে বেশি বসে, যার ফলে এদেরকে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জন্য ঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এডিস মশা নিধনের জন্য যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, তা কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। ডোজ কেলিব্রেশন, স্প্রে করার স্থান নির্ধারণ ও স্প্রে করার সময় হাটার স্পীড সব সঠিক নিয়মে মেনে চলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মশার প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি এমনভাবে নিতে হবে যেন আমাদের আশপাশ পরিচ্ছন্ন থাকে। মশা নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, এনজিও কর্মী সচেতন নাগরিক সবাইকে নিয়ে ক্রাস অ্যাকশন বাস্তবায়ন করতে হবে। ডেঙ্গুর মশা এডিস নিধনে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে বর্তমান সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধের উপর গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি পালন করা দরকার। এডিস মশার প্রাদূর্ভাব মানুষের জীবন বা জীবনের ঝুঁকি জড়িত। কাজেই এ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য কোন প্রকার অনিয়ম বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়ার অবকাশ নেই।ডেঙ্গু সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট একটি দুর্যোগ, আমাদের কর্মফলই এজন্য বহুলাংশে দায়ী। আমরা পরিবেশের উপর যে অন্যায় ও বিরূপ আচরণ করছি, তারই ফলস্বরুপ এই রোগ আমাদের দেশে ছড়িয়ে পরছে। এখনই পরিবেশ রক্ষায় ও পরিবেশ দূষণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে সামনে এই জাতিকে ডেঙ্গুর মত আরও ভয়াবহ পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলা করতে হতে পারে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমাদের গবেষণা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমাদের বাহক বা এডিস মশা নিধন ছাড়া আর কোন করণীয় বিষয় নেই। এক্ষেত্রে আমাদের জনবল ঘাটতি রয়েছে, গবেষণার অনেক সুবিধাদি নেই। কৃষিতে আমাদের দেশে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণার অনেক ঘাটতি রয়েছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে গবেষণা বাড়াতে হবে, এক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে হবে।
বাংলাদেশে ক্রপ হেলথ সেক্টরে পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ নিয়োজিত থাকলেও পাবলিক হেলথ সেক্টরে পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ প্রদান করতে হবে। ডেঙ্গুর উপর গবেষণার জন্য একটি উন্নত ও আধুনিক সুবিধা সম্বলিত ল্যাব স্থাপন করা এখন সময়ের দাবী। যেখান থেকে এডিস মশা নির্মূলের আধুনিক ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ, কীটনাশকের মান নিয়ন্ত্রণ, ডোজ কেলিব্রেশন ও সাবলিথাল বা বেশি ডোজে প্রয়োগের ফলে মশা রেজিস্টান্ট হয়ে যাচ্ছে কিনা এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা প্রণয়ন করতে হবে।
আমাদের দেশের একটি গোষ্ঠী এখনো সচেতন নয়, তারা কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর, অনেক ক্ষেত্রে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। জনগোষ্ঠীর এই অংশ যতদিন ব্যক্তি স্বার্থ পরিত্যাগ না করে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে সমাজ ও দেশকে বড় করে না দেখবে, তত দিন ডেঙ্গুর মত এ ধরণের সামাজিক ও জাতীয় সমস্যা নির্মূল করা সম্ভব নয়। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ ধরণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত কঠিন ও দু:সাধ্য।