সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোক্তার ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে আয় বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ; অর্থাৎ আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ শতাংশ। ফলে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ভোক্তাকে বাড়তি অর্থঋণ বা ধার করে নির্বাহ করতে হচ্ছে। বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যে এখন পর্যন্ত সক্রিয়, তা এ তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায়। বিগত ২০২২ সালের এপ্রিল মাস থেকে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ায় অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকেও এর প্রভাব পড়ে।
বিশেষ করে, খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ডাবল ডিজিট অতিক্রম করায় এ খাতে মানুষের খরচ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। কারণ যে দুটি অপরিহার্য খাতে মানুষের ব্যয় সবচেয়ে বেশি হয়, তা হলো খাদ্য ও চিকিৎসা।
আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের মূল্য কমলেও আমাদের দেশে কমছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কারণে আমদানি ব্যয় কমে গেছে। চাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল, ডিম, তেল, চিনিসহ কিছু পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম ১০০ ডলার থেকে কমে ৭৮ ডলারে নেমে আসায় জাহাজ ভাড়াসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও পরিবহন ব্যয় কমেছে। কিন্তু তার পরও আমদানিজাত পণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার পরিবর্তে আরো বেড়েছে। ২০২২ সালে বৈশ্বিক মন্দা শুরুর আগে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে। বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাবে এ হার বাড়তে শুরু করে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ে। শুধু তা-ই নয়, যেসব পণ্য আমদানিনির্ভর নয়, দেশেই উৎপাদন হয়, সেগুলোর দামও উর্ধ্বমুখী। ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফালোভী মানসিকতা ও চাঁদাবাজির কারণে মূল্যস্ফীতিতে বাড়তি চাপ পড়ছে। এভাবে ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কেটে জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার অনেক দেশেই কমে গেছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতে ৫.৩ শতাংশ, ভুটানে ২.৩ শতাংশ, নেপালে ৪.১ শতাংশ, পাকিস্তানে ২.৫ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ০.৮ শতাংশে নেমেছে। ২০২১ সালের মে মাসে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতির হার ছিল ৪.৮৭ শতাংশ। ২০২২ সালের এপ্রিলে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ৬.২৩ শতাংশ। মে মাসে আরো বেড়ে হয় ৮.৩০ শতাংশ। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৭১ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ৯.৪১ শতাংশ এবং চলতি বছরের এপ্রিলে হয় ১০.২ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১০ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি বেড়ে হয় ১২.৬৬ শতাংশ। বিগত দুই বছরে টাকার মান কমেছে ৪৭ থেকে ৫৩ শতাংশ। আসন্ন রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাড়ছে আরো দাম। রোজা শুরুর তিন মাস আগে থেকে মুনাফালোভীরা শুরু করেছে কারসাজি। বিগত কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির অত্যধিক চাপে অধিকসংখ্যক মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে গেছে। সাধারণ মানুষ মাছ-মাংস খাওয়া তো দূরের কথা; চাল, ডাল, আলু, তেল কিনতেই হাঁপিয়ে উঠছে।
২০২২ সালে জুলাইতে প্রতিটি ডলারের মূল্য ছিল ৮৫ টাকা। সেই ডলার বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রয় হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে পণ্যের দাম বাড়াতে ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অর্থসংকটে বাড়িভাড়া, স্বাস্থ্য, পরিবহন, বিনোদন খাতসহ অনেক খাতে মানুষ ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের তালিকা কাটছাঁট করায় পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষ। এই শ্রেণির মানুষরা তাদের আয়ের প্রায় সবটুকু খাদ্যপণ্যের জন্য ব্যয় করেও পুষ্টিকর খাবার খেতে পাচ্ছে না। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বেকার সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে মাথাপিছু গড় আয় বাড়লেও তা সব শ্রেণির মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। দেশ থেকে একটা বিশাল পরিমাণে অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি, ব্যাংক-ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি, বেসরকারি বিনিয়োগ হ্রাস, ডলারের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়া ইত্যাদি সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে এক অশনিসংকেতের সৃষ্টি হয়েছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ আশু প্রয়োজন।
দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতি বোঝে না। তারা শুধু বোঝে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে অছে কিনা। যে বা যারা এ নিশ্চয়তা দিতে পারবে, মানুষ তাকেই সাদরে গ্রহণ করবে। মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির দিকে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব বাধাবিঘ্ন রয়েছে, তা দূর করতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি কৃষি, শিল্প, গার্মেন্ট ও রেমিট্যান্সের ওপর সময়োপযোগী ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, সঠিক পরিসংখ্যানের অভাব। দেশে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে চাহিদা ও জোগানের সঠিক তথ্য না পাওয়ায় সমস্যার সমাধান করা কঠিন হয়।
চলতি বছরের মার্চ মাসে বিবিএসের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবারের মধ্যে ২৬ শতাংশ পরিবার তাদের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে চলেছে। অর্থসংকটের কারণে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে তারা পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছেন। বিগত বছরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের ৭১ শতাংশ পরিবার উদ্বিগ্ন রয়েছেন। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সীমিত বা নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার ফলে জনসংখ্যার একটি অংশকে দারিদ্র্যসীমার নিচে আসতে বাধ্য করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিবিএসের প্রতিবেদন থেকে আরো জানা যায়, স্বাস্থ্য খাতে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। ওষুধের দাম, হাসপাতালের খরচ, ডাক্তারের ভিজিট অত্যধিক হওয়ায় এ খাতের ব্যয় বেড়ে গেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এ খাতে ব্যয় বেড়েছিল ১.১১ শতাংশ। একই বছরের ডিসেম্বরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে দাঁড়ায় ১৯.৭৭ শতাংশে। সরকার নিত্যপণ্যের শুল্ক কমালেও এর সুফল পাচ্ছে বাজার সিন্ডিকেটের মাফিয়া চক্র। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাব) নামে যে সংস্থাটি রয়েছে, তাদের কার্যক্রমও হতাশাব্যঞ্জক। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ একটা হতাশাজনক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য উল্লিখিত বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সব ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক, সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক