প্রতিদিনের স্বদেশ ডেস্ক:
শিল্প খাতে গ্যাসের দাম প্রায় ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাবে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্প খাতের ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, গ্যাসের দাম বাড়লে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোতে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। শিল্পায়ন ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে যখন শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তখন শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তার সুফল শিল্প পায়নি।সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বরাবর পাঠানো এক চিঠিতে এসব তথ্য জানানো হয়। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল ও বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) চেয়ারম্যান হোসেন মেহমুদ চিঠিতে সই করেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বেশকিছু প্রতিবেদনের সূত্রে আমরা অবগত হয়েছি যে, সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্য পুনরায় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৭৫ টাকা করা হতে পারে। এরূপ মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর করা হলে তা শিল্পায়ন ও অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। করোনা মহামারির অভিঘাত মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে আমাদের বস্ত্র ও পোশাক খাত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ এবং বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপের সম্মুখীন হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, তবে বিগত তিন অর্থবছরের তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি বিচারে রপ্তানিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে, যা অর্থনীতির ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির জন্য উদ্বেগজনক।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে গ্যাসের মোট সরবরাহ ছিল ২৫ হাজার ৯৪৭ এমএমসিএম, যার ১৮ শতাংশ সরবরাহ করা হয়েছে শিল্প খাতগুলোয়। শিল্পে ব্যবহৃত মোট গ্যাসের প্রায় ৩০ শতাংশ সরবরাহ হয় পোশাক খাতে, সেই হিসেবে এই শিল্পের বার্ষিক গ্যাসচাহিদা প্রায় ১ হাজার ৪০০ এমএমসিএম। গ্যাসের মূল্য যদি প্রতি ঘনমিটারে ৪৫ টাকা বৃদ্ধি পায়, তবে এই খাতে বার্ষিক অতিরিক্ত প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধি পাবে, যা রপ্তানি আয়ের প্রায় ১ দশমিক ৫ শতাংশ। পাশাপাশি, টেক্সটাইল শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যবহার করে, যার পরিমাণ বছরে প্রায় ২ হাজার ৫৯৫ এমএমসিএম। ৪৫ টাকা হারে মূল্য বৃদ্ধি করা হলে টেক্সটাইল শিল্পের ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে বছরে প্রায় অতিরিক্ত ১১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা খরচ বহন করতে হবে, যা বার্ষিক পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ২ দশমিক ৭ শতাংশ; অর্থাৎ, এই ব্যাপক হারে খরচবৃদ্ধি শিল্পের সক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা রয়ে গেছে বলে ব্যবসায়ীরা তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেন।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বৈশ্বিক পর্যায়ে পোশাকের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমেও ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আংকটাড প্রকাশিত গ্লোবাল ট্রেড আপডেট প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৪ সালে বিশ্বে পোশাক আমদানি ৫ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের শিল্পে, বিশেষ করে রপ্তানি মূল্যের ওপর। উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারগুলোতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পোশাকের মূল্য যথাক্রমে ৪ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়।’
চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিগত পাঁচ বছরে গ্যাসের মূল্য বেড়েছে ২৮৬ দশমিক ৫ শতাংশ, বিদ্যুতের মূল্য বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ, ডিজেলের মূল্য বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংক-সুদ বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ হয়েছে। সার্বিকভাবে বিগত পাঁচ বছরে কারখানার গড় উৎপাদন খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই রপ্তানি খাতে প্রচলিত প্রণোদনা কমিয়ে আনা হয়েছে। বর্তমানে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির উদ্যোগটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন আমাদের কারখানাগুলো গ্যাসের অপর্যাপ্ত চাপ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পরিচালিত হচ্ছে এবং ব্যাপক আর্থিক লোকসানের শিকার হচ্ছে। আমাদের শিল্পঘন এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে অবস্থিত কারখানাগুলোয় গ্যাস-সংকটের কারণে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ হারে উৎপাদন কমে গেছে। শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি রপ্তানি বিঘ্নিত হচ্ছে, লিড টাইম ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে এবং আমরা ক্রেতাদের আস্থা হারাচ্ছি। এরকম পরিস্থিতিতে শিল্প খাত ও ক্যাপটিভ পাওয়ার প্লান্টগুলোতে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির পরিকল্পনা স্থগিতের আহ্বান জানান তারা।