মোঃ আল মাসুম খান
খুলনার আলোচিত সমালোচিত নারী ব্যবসায়ী নাসরিন ইসলাম তন্দ্রা ওরফে নাসরিন পারভেজ তন্দ্রা অবশেষে পুলিশের হাতে আটক খুলনা জেলা কারাগারে বন্দি আছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত খুলনা মহানগর যুব মহিলা লীগের নেত্রী নাসরিন সুলতানা ওরফে তন্দার নারী ব্যবসার গোপন তথ্য বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন মাধ্যম হইতে। উল্লেখ্য গত মাসের ২৬ মে কেএমপি গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা বিমানবন্দর থানা পুলিশ তাকে আটক করেছেন। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নাসরিন সুলতানা তন্দ্রা মালায়েশিয়া থেকে বিমানযোগে ঢাকায় অবতরণ করেছিলেন এবং গত মাসের ২৮ মে চট্টগ্রাম থেকে তন্দ্রার ইটালিয়ান ভিসা সংগ্রহ করা কথা ছিলো। তন্দ্রার বাংলাদেশ আগমনের তথ্য গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কেএমপির গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পেরে বিষয়টি ঢাকার বিমান বন্দর থানাকে অবহিত করলে বিমানবন্দর থানা পুলিশ তাকে আটক করেন। খুলনার আলোচিত নারী ব্যবসায়ী একসময় এনজিও কর্মী ছিলেন। পতিত সরকারের আমলে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা মালিক হয়েছেন। খুলনায় নাসরিন পারভেজ তন্দ্রা নতুন পাপিয়া হিসেবে পরিচিত। খুলনা, গোপালগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে কিনেছেন জমি। খুলনা সোনাডাঙ্গা থানাধীন বয়রাতে নির্মাণ করেছেন চোখ ধাঁধানো আলিশান বাড়ি। ডুপ্লেক্স বাড়িটির আন্তঃসজ্জাই মনে করিয়ে দেবে তার অর্থের উৎস! এছাড়া রায়ের মহলে কোটি টাকা মূল্যের বেশ কয়েকটি প্লট রয়েছে। রয়েছে তিনটি দামি ব্রান্ডের গাড়ি। তবে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে একটি গাড়িতে ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। সামান্য এনজিও কর্মী থেকে কিভাবে কোটি টাকার মালিক বনেছেন তা নিয়ে জন্ম নিয়েছে নানা প্রশ্ন।অনুসন্ধানে জানা যায়, আওয়ামী লীগের এমপি, মেয়র সহ উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় হতদরিদ্র থেকে কোটিপতি হয়েছেন তন্দা। উল্লেখ্য গত ১৫ বছরে খুলনায় আওয়ামী লীগের নেতাসহ প্রায় ৫০ জন প্রভাবশালীকে তুরুপের তাস বানিয়েছিলেন তন্দ্রা। ওই সকল নেতাদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করেছিলেন রংমহল। তন্দ্রার রংমহলে রাখা হতো খুলনার বিভিন্ন নারীদেরকে। অর্থের লোভ ও ভাই ভীতি দেখিয়ে তাদের দিয়ে বাধ্য করানো হতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে। খুলনার রাজনীতিবিদ ও বিত্তশালীরা ছিলো ওই রংমহলের নিয়মিত খদ্দের। তবে হাইপ্রোফাইলদের জন্য ছিল ভিন্ন আয়োজন। দেশের নামিদামী পর্যটক কেন্দ্রের রিসোর্ট ভাড়া করে নেতাদের মনোরঞ্জন করার ব্যবস্থা করতেন এই তন্দ্রা। সেখানে নামিদামি মডেলদের সরবরাহ করতেন তিনি। বিনিময়ে এ সকল রাজনৈতিক ও বিত্তবান ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে নিতেন নগদ অর্থ, সম্পত্তি, ব্যবসায়িক অংশীদারিত্ব। পদ ও পদবি পাওয়ার লোভ দেখিয়ে বেশ কয়েকজন নারীকে দিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ড করাতে বাধ্য করতেন তন্দ্রা এমন অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। তবে এ বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই ব্যাপক ক্ষোভ ছিলো খুলনা মহানগর আওয়ামী মহিলা লীগের নেত্রী ও কর্মীদের ভিতরে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় অর্থের মোহ তাকে গ্রাস করেছিলো। তার দ্বারা যেটি সম্ভব, আমাদের দ্বারা সেটি সম্ভব নয়। তাই তাকে দলের নেতারা বেশি প্রাধান্য দেয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেত্রী গণমাধ্যমকে জানান, তন্দ্রার মূলত বিবাহ তিনটি। প্রথম স্বামীর ঘরের দুই মেয়ে সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন যাপন করতো । এক পর্যায়ে প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একটি এনজিওতে কাজ করতেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তেমন কোন চাকরি পাননি তিনি। সে সময় খুবই মানবেতর জীবন যাপন করতেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিবাহ করেন তিনি। তবে দ্বিতীয় সংসারও বেশিদিন টেকেনি। পরবর্তীতে উচ্চ আকাঙ্খা ও আরাম আয়েশের জীবন যাপনের লালসায় বশীভূত হয়ে অনৈতিক পথ বেছে নেয় তন্দ্রা। খুলনা মহানগরীর হরিণটানা রিয়াবাজার সংলগ্ন একটি ফ্ল্যাট বাসায় শুরু করে অবৈধ দেহ ব্যবসা। সেই থেকেই শুরু হয় তন্দ্রার উত্থানের গল্প। তার ওই ফ্ল্যাট বাসায় সরকারি কর্মকর্তা, বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আনাগোনা ছিল। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জালে আটকা পড়ে পাপিয়া খ্যাত তন্দ্রা। তবে সেখানেই দফারফা হয়। অদৃশ্য ক্ষমতা ও টাকার মাধ্যমে ছাড় পায় তন্দ্রা। পরবর্তীতে রিয়াবাজার সংলগ্ন ওই বাসা ছেড়ে অন্যত্র ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। খুলনা খালিশপুর এর মুজগুন্নি আবাসিক এলাকা, বয়রা ও রায়েরমহল সহ বেশ কয়েকটি এলাকায় গড়ে তোলে রমরমা দেহ ব্যবসা। নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদপ্রাপ্তির বিষয়কে কেন্দ্র করে নানা অভিযোগ তোলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ অঙ্গ সংগঠন গুলোর নারী নেত্রীরা। তারা জানান, তন্দ্রা খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের উচ্চপদস্থ নেতা- কর্মীদের মনোরঞ্জন করে সোনাডাঙ্গা থানা শাখার প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদিকা পদে নিযুক্ত হন। এছাড়া পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে ২০২২ সাল থেকে যুব মহিলা লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। খুলনায় অবস্থানরত একটি বিশেষ পরিবারের দৃষ্টি আনেন নিজের প্রতি। অজানা কৌশলে মহিলা যুবলীগ সম্মেলন প্রস্তুত কমিটিতে যুগ্ন আহবায়ক হন। যা নিয়ে বারংবার সৃষ্টি হয়েছে নানা বিতর্ক।
এছাড়া রাজনীতির বাইরে বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীদের টার্গেট করতেন তন্দ্রা। প্রথমে ব্যবসায়ের প্রস্তাব দিতেন। পরবর্তীতে ডেকে নিতেন তার নিজস্ব রংমহলে। এরপর চলতো ব্ল্যাকমেইলিং পর্ব। আপত্তিকর অবস্থায় ফেলে ধারণ করা হতো ভিডিও। পরবর্তীতে এই ভিডিওর ভয় দেখিয়ে নেওয়া হতো মোটা অংকের টাকা। নারী ব্যবসায়ী তন্দ্রার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারানো খুলনার অনেকেই মধ্যে একজন জানান, খুলনা মোস্তফার মোড়-কৈয়া বাজার বাইপাস সড়ক সংলগ্ন স্থানের একজন প্লট ব্যবসায়ীর সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে নারী ব্যবসায়ী তন্দ্রার। প্লট বেচাকেনা সম্পর্কিত বিষয়ে অর্থ বিনিয়োগের কথা বলেন তন্দ্রা। এক পর্যায়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান সেই প্লট ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে কথিত রঙ্গমঞ্চে নিমন্ত্রণ জানানো হয় তাকে। প্রেমের ফাঁদে ফেলে, গোপনে তার আপত্তিকর অবস্থার ভিডিও ধারণ করেন। সে ভিডিওটি পুঁজি করে মোটা অংকের টাকা দাবি করেন। পাশাপাশি প্লট ব্যবসায়ের অংশীদার হন তিনি। খুলনার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালীর নগ্ন ভিডিও ফাঁস করার ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে গোপন তথ্য রয়েছে। খুলনা জেলা কারাগারে আটক নাসরিন সুলতানা ওরফে তন্দ্রা বাগেরহাট রামপাল উপজেলার ইতালি বাবু নামক এক যুবকের সাথে তৃতীয় বারের মত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই সূত্রে ইতালিতে পাঠানোর নাম করে খুলনা সহ বিভিন্ন জেলার মানুষের নিকট থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে।
ডিএমপির বিমানবন্দর থানার ওসি তাসলিমা আক্তার গণমাধ্যমকে জানান, কেএমপির তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করা হয়েছে। আটককৃত নাসরিন খুলনার থানার মামলার সন্দেহ জনক আসামী। তাকে খুলনায় পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। উল্লেখ্য খুলনা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি তৈমুর ইসলাম জানান, খুলনা সদর থানার মামলা নং ২৪ তারিখ ১৮ মার্চ ২০২৫ এর সন্দিগ্ধ আসামী তন্দ্রা। গোপন সংবাদে জানা যায় তিনি মালায়েশিয়া থেকে ঢাকায় আসছেন। সে মোতাবেক এয়ারপোর্ট থানাকে অবহিত করা হলে তারা তন্দ্রাকে আটক করে।