মো: আল মাসুম খান
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর গুলোতে যাত্রী তথ্য ব্যবস্থাপনার মতো ‘স্পর্শকাতর’ প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছেন ঢাকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ আলি আলহামুদি; একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে তাঁর রয়েছে ৩৪ শতাংশ মালিকানা। রাষ্ট্রদূতের এ ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতা ঘিরে উঠেছে স্বার্থের সংঘাত, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ।
এই নতুন প্রযুক্তি নির্ভর তথ্য ব্যবস্থাটি বাস্তবায়ন করছে আমিরাত ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি এমিরেটস টেকনোলজি সলিউশনস (ইটেক)। প্রতিষ্ঠানটি সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়েছে আইডেন্টিমা নামের দুবাই ভিত্তিক একটি কোম্পানিকে; যার ৩৪ শতাংশ শেয়ার রাষ্ট্রদূত আলহামুদি’র নিজের এবং তিনি প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার হিসেবেও তালিকাভুক্ত রয়েছেন।
স্বার্থের সংঘাত ও ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান একে একটি স্পষ্ট স্বার্থের সংঘাত বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতের মতো একজন সরকারি কর্মকর্তা সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারেন না; এটি কেবল নৈতিকতার নয়, কূটনৈতিক শিষ্টাচারেরও লঙ্ঘন।
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন— রাষ্ট্রদূত যে বিনিয়োগ করেছেন, সেই মূলধন কোথা থেকে এসেছে ? এই বিনিয়োগ কি সরকারি অনুমোদন পেয়েছিল ?
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের ভিয়েনা কনভেনশন ১৯৬১ অনুযায়ী, কোনো কূটনৈতিক প্রতিনিধি তার কর্মরত দেশে ব্যক্তিগত ভাবে বাণিজ্যিক বা পেশাগতভাবে লাভবান হওয়ার অধিকার রাখেন না।
বাংলাদেশি দুই অংশীদার ও বিতর্কিত অতীত
আইডেন্টিমার বাকি দুই অংশীদার হলেন— মুনতাসির বিল্লা শাহরিয়ার ও সাজেদ আহম্মাদ সামি; উভয়েরই রয়েছে ৩৩ শতাংশ করে শেয়ার। শাহরিয়ারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে চুক্তিতে সুবিধা পেয়েছেন।
প্রতিষ্ঠান দুটির পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকলেও, তাদেরকেই এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার কাজ দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে আইডেন্টিমা চুক্তি করে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক সিটা নামক একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে; যারা বিমান বন্দরের তথ্য ব্যবস্থাপনায় বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত।
অস্বাভাবিক ফি ও সাধারণ যাত্রীর ওপর চাপ
সিটা’র সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলাদেশকে প্রতিজন যাত্রীর জন্য প্রাথমিক ভাবে ৬.৫০ মার্কিন ডলার ফি নির্ধারণ করা হয়; যা পরবর্তীতে কমিয়ে ৪ ডলারে আনা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইসিএও) এর সুপারিশ অনুযায়ী, এ ধরনের ফি সর্বোচ্চ ৩.৫০ ডলার হওয়া উচিত। উল্লেখ যোগ্য হলো, আমিরাত নিজ দেশে একই সেবার জন্য সিটাকে দিচ্ছে মাত্র ১.৫০ ডলার। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা শেষ পর্যন্ত গরিব ও মধ্যবিত্ত বিদেশগামী শ্রমিকদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
চুক্তির অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
আইডেন্টিমা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০২১ সালে; সে সময় আলহামুদি ছিলেন বাংলাদেশে আমিরাতের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির পর আইডেন্টিমা পায় প্রকল্পটির দায়িত্ব। ২০২৪ সালের ২ জুলাই রাষ্ট্রদূত আলহামুদি এই চুক্তির নবায়ন করেন ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
তবে প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ বর্তমানে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি (ক্যাব) জানিয়েছে, বাস্তবায়নে অগ্রগতি ‘ধীরগতির’। নতুন কমিটি গঠন করে বিকল্প আন্তর্জাতিক প্রস্তাব যাচাই করা হচ্ছে।
নতুন কূটনৈতিক বাস্তবতা ও আমিরাতের আগ্রহ
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মোড় নেয়। এর পরপরই আমিরাত সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, প্রযুক্তি, পর্যটন, জাহাজ চলাচলসহ বিভিন্ন খাতে একাধিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্পর্শকাতর জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রকল্প গুলোতে বিদেশি রাষ্ট্রদূতের সরাসরি ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততা শুধু কূটনৈতিক নিয়ম লঙ্ঘন নয়; বরং এটি একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে।