এমডি আল মাসুৃম খান,অনুসন্ধানী সাংবাদিক
চাচা হত্যার বদলা নিতেই খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে ঋতু নামের ২৪ বছর বয়সী এক নারীকে ফাঁদ (হানি ট্র্যাপ) হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে কক্সবাজার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ।তিনি বলেন, চরমপন্থি সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি খুলনার নেতা ছিলেন হুজি শহীদুল। ২০১৩ সালে যাকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন কাউন্সিলর টিপু। হুজি শহীদুল হত্যা মামলার চার আসামির মধ্যে একজনকে একইভাবে ২০২২ সালে হত্যা করা হয়। আর হুজি শহীদের ভাতিজা হলেন পুলিশের হাতে আটক শেখ শাহরিয়ার পাপ্পু। সেখান থেকেই শত্রুতা ও ক্ষোভ তৈরি হয়।।পুলিশ সুপার বলেন, স্থানীয় আধিপত্য ও প্রভাব বিস্তারের বিষয়ও রয়েছে এ হত্যার পেছনে। খুব সুকৌশলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড করার জন্য আসামিরা কক্সবাজারকে উপযুক্ত স্থান মনে করেছেন। রহমত উল্লাহ বলেন, এই তিনজনই হত্যার সময় কক্সবাজার অবস্থান করছিলেন। টিপুর সঙ্গে থাকা নারী, কাউন্সিলর টিপুর গতিবিধি জানিয়েছেন খুনে জড়িত পাপ্পুকে। সহযোগী গোলাম রসুলসহ পাপ্পু উঠেছিলেন কক্সবাজার শহরের কক্স কুইন রিসোর্টে। হত্যার পর তারা অস্ত্রটি ওই রিসোর্টের ২০৮ নম্বর কক্ষের চিলেকোঠায় রেখে পালিয়ে যান। পরে অস্ত্রটি পুলিশ উদ্ধার করে। তাদের এই অস্ত্রের যোগানদাতা কে বা কারা তা তদন্ত করা হচ্ছে। এদিকে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া তিন আসামি ঋতু, শেখ শাহরিয়ার ইসলাম ও গোলাম রসুল গত বুধবার কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে খুনের বর্ণনা উঠে আসে। জবানবন্দিতে শেখ শাহরিয়ার ইসলাম বলেন, শহীদুল তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। দুজন পূর্ব বাংলা চরমপন্থী দলের নেতা কামরুলের অনুসারী ছিলেন। চাচা শহীদুলের পক্ষে কাজ করায় রব্বানী টার্গেট করে তাকে (শাহরিয়ার) বিভিন্ন মামলায় আসামি করেন। কিন্তু রব্বানী ক্ষমতায় থাকায় কিছুই করতে পারছিলেন না। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে রব্বানী আত্মগোপন করেন। এরপর রব্বানীকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যা পরিকল্পনার কথা প্রথমে শেয়ার করেন বন্ধু রিয়াজকে। রিয়াজ মাসখানেক আগে ঋতুকে দিয়ে তার প্রতিবেশী রব্বানীকে খুনের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঋতু রব্বানীকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান, রব্বানী ঋতুকে বন্ধু করে নেন। ঋতুকে ফেসবুকে রব্বানীর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যেতে বলা হয়। ঋতু কক্সবাজার বেড়াতে যেতে বলেন রব্বানীকে। ভ্রমণে যেতে রাজি হন রব্বানী। এরপর কক্সবাজার সৈকতে নিয়ে রব্বানীকে হত্যার পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করেন রিয়াজ ও শাহরিয়ার। হত্যা পরিকল্পনার কথা জানানো হয় মিল্লাত গাজী ও নিহত চাচা হুজি শহীদুলের দেহরক্ষী রিপনকে। রিপনের নির্দেশনায় রায়হান নামের আরেকজন শাহরিয়ারের হাতে তুলে দেন পাঁচটি গুলিসহ একটি পিস্তল। জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, মিল্লাত নামের একজন থাকার জন্য কক্সবাজারে হোটেল ঠিক করে দিয়ে শাহরিয়ারের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন। গোলাম রসুল ৭ জানুয়ারি কক্সবাজারে চলে যান। শাহরিয়ার, কামরান, সাব্বির ও রিয়াজ কক্সবাজার আসেন। ৯ জানুয়ারি দুপুরে কক্সবাজার পৌঁছে শাহরিয়ার গোলাম রসুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রসুলের কথামতো সবাই কলাতলীর কক্স কুইন রিসোর্টে ওঠেন। তাদের সঙ্গে একই রিসোর্টে ওঠেন সানি ও মেহেদী নামের আরও দুজন। রিসোর্টের দ্বিতীয় তলায় ২০৮ নম্বর কক্ষে ওঠেন শাহরিয়ার, সাব্বির, কামরান ও গোলাম রসুল। নিচতলার ১০২ নম্বর কক্ষে ওঠেন সানি, মেহেদী ও রিয়াজ। একই দিন সকালে ঋতুর সঙ্গে কক্সবাজার পৌঁছান গোলাম রব্বানী। তারা ওঠেন কলাতলীর আরেক হোটেল গোল্ডেন হিলে। রিয়াজ মুঠোফোন ও খুদে বার্তার মাধ্যমে ঋতুর সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন। আদালতের জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, ৯ জানুয়ারি বিকেল পৌনে ছয়টার দিকে রব্বানীকে নিয়ে ঋতু হোটেল থেকে সৈকতের দিকে যেতে থাকেন। ঋতুর কথামতো আগে থেকে গোল্ডেন হিলে পৌঁছান সানি, মেহেদী ও গোলাম রসুল। অন্যদিকে শাহরিয়ার, রিয়াজ, কামরান ও সাব্বির সৈকতে নামেন। একইদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের হোটেল সিগাল পয়েন্টের বালুচরে পর্যটকদের সমুদ্র দর্শনের জন্য বসানো চেয়ার-ছাতার ‘কিটকটে’ বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী ওরফে টিপু এবং তরুণী ঋতু। রাত আটটার দিকে কিটকট ছেড়ে দুজন সৈকত থেকে হেঁটে সিগাল হোটেলের দিকে যাচ্ছিলেন। ঋতু রব্বানীর চার-পাঁচ কদম আগে আগে হাঁটছিলেন। পেছনে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন গোলাম রব্বানী। ঋতুর ইশারায় আগ থেকেই গোলাম রব্বানীকে নজরদারিতে রাখেন শেখ শাহরিয়ার ইসলাম ওরফে পাপ্পুসহ চারজন। সৈকত থেকে পাকা সড়কে ওঠার জন্য গোলাম রব্বানী যখন ঝাউবাগানের ভেতরে চলে আসেন, তখন সামনে এগিয়ে যান শেখ শাহরিয়ার। তারপর অন্ধকার রাতে পেছন দিক থেকে রাব্বানীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটি গুলি ছোড়েন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটে পড়েন রব্বানী। এরপর গোলাম রসুলকে (২৫) সঙ্গে নিয়ে শেখ শাহরিয়ার রিকশায় উঠে চলে যান কক্স কুইন রিসোর্টে। আর ঋতু ও রিয়াজ নামের অপর দুজন সরে পড়েন অন্যদিকে। পুলিশ জানায়, রব্বানীর হত্যাকাণ্ডের পর ঋতুর হদিস পাচ্ছিলেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। একপর্যায়ে হোটেল কক্ষ থেকে ঋতুর বাসের লাগেজ ট্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ট্যাগ ছিল ইম্পেরিয়াল এক্সপ্রেস নামের একটি বাসের। একপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পুলিশ ঋতুর অবস্থান শনাক্ত করে। এরপর মৌলভীবাজারের জিরি থানার কাপনা পাহাড় এলাকার জনৈক বিকাশের বাড়ি থেকে ঋতু, গোলাম রসুল ও শাহরিয়ার ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শাহরিয়ারের তথ্যমতে, পুলিশ কক্সবাজারের কক্স কুইন রিসোর্টের ২০৮ নম্বর কক্ষের বাথরুমের ওপরে চিলেকোঠা থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি পিস্তল ও চারটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিন উদ্ধার করে।