মো: আল মাসুম খান
জুলাই – আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় গত ১০ মাসে সারাদেশে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৭৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। উল্লেখ্য এর মধ্যে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ১০৯ জন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৬৮৯ জন। বাংলাদেশ পুলিশের প্রতিদিনের গ্রেপ্তার সংক্রান্ত পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।আগস্টের পরের কয়েক মাস পুলিশ প্রশাসন অনেকটা স্থবির ছিল। প্রায় ৪৫০ থানা ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় আগস্ট সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার ছিল তুলনা মূলক কিছুটা কম ছিল। উল্লেখ্য এই প্রতিবেদনে সাধারণ মামলা এবং জুলাই অভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট মামলার আসামিদের আলাদা ভাবে চিহ্নিত করা হয়নি। এখানে সার্বিক গ্রেপ্তারের হিসাব স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে কত মানুষ জামিন পেয়েছে একক কোনো সূত্র থেকে সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কারাগার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সারাদেশে কারাগারের সংখ্যা ৬৯। এসব কারাগারে বন্দি ধারন ক্ষমতা ৪২ হাজার ৮৮৭। আর বর্তমানে বন্দি আছে ৭৩ হাজার ৬ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৭০ হাজার ৪১৭ এবং নারী ২ হাজার ৫৮৯ জন। এর বাইরে কিশোর সংশোধনাগারে কিছু বন্দি থাকে। কারা অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন) জান্নাত উল ফরহাদ গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিদিন কারাগারে নতুন করে ঢোকা বন্দি এবং জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা সাধারণত কাছাকাছি থাকে। সর্বশেষ ২৯ মে ২ হাজার ৫৫৩ জন কারাগার গুলো থেকে জামিনে বের হয়েছেন। সেদিন ১ হাজার ৮৩২ জন নতুন বন্দি কারাগারে ঢুকেছেন। তিনি বলেন, কারাগারে ধারন ক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকলেও তাদের স্থান সংকুলানে সমস্যা হচ্ছে না। প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মে মাসে গ্রেপ্তার হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার ২০৮ জন। গড়ে প্রতিদিন গ্রেপ্তার ১ হাজার ৪৫৮, অবশ্য প্রথম পাঁচ মাসে প্রতিদিনের গড়ে গ্রেপ্তার ছিল ৯৭৪ জন। আর পরের পাঁচ মাসের দৈনিক গড় গ্রেপ্তার ১ হাজার ৪২৪ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে, স্বাভাবিক সময়ে দেশে দৈনিক গড় গ্রেপ্তার এক হাজারের কাছাকাছি। মাসে ৩০ হাজারের মতো। উল্লেখ্য বর্তমানে বিশেষ কোনো নাম দিয়ে অভিযান না চললেও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশ তৎপর। এর মধ্যে রাজনৈতিক দল বিশেষ করে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের গ্রেপ্তারের খবর বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আবার মব সৃষ্টি, হামলা-ভাঙচুর, দখল চাঁদাবাজির প্রকাশ্য ও আলোচিত ঘটনা গুলোর ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের তথ্য বেশ কম। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়। ২১ দিনে সারাদেশে ৩২ হাজার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ডেভিল হান্ট অভিযানে গ্রেপ্তার হয় ১২ হাজার ৫০০ জন। অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে ১৯ হাজার ৫৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গড়ে প্রতিদিন গ্রেপ্তার হয় ১ হাজার ৫২৫ জন। এই অভিযান চলাকালে প্রতিদিনের গ্রেপ্তারের পরিসংখ্যান জানাত পুলিশ সদর দপ্তর। সেখানে ডেভিল হান্ট ও অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তারের সংখ্যা আলাদা ভাবে উল্লেখ করা হতো। পরে ডেভিল হান্ট নাম নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি তোলায় ওই নামে অভিযান বন্ধ করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছরের শুরু থেকে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। জানুয়ারিতে সারাদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪০ হাজার ৪২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪১ হাজার ১৮১, মার্চে ৪৩ হাজার ৯২০ ও এপ্রিলে ৪৩ হাজার ৭৬৬ জন। এর আগে ২০২৪ সালের আগস্টে সারাদেশে গ্রেপ্তার ছিল ১৫ হাজার ৪৯২। সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৬০৭, অক্টোবরে ৩৫ হাজার ১৯২, নভেম্বরে ৪১ হাজার ৬৪ ও ডিসেম্বরে ৩৭ হাজার ৩২৬ জন। বাংলাদেশ পুলিশের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সাধারণত গড়ে প্রতিদিন যে সংখ্যায় গ্রেপ্তার হতো, এখন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি হচ্ছে। স্বাভাবিক সময় গড়ে দিনে সারাদেশে এক হাজারের কম বেশি গ্রেপ্তার হতো। পুলিশ এখন পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তাই অভিযান ও গ্রেপ্তারে গতি এসেছে। দেশে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তাদের নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা কোথায় কী ধরনের অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে যুক্ত, তার ওপর বাড়তি নজর থাকছে। ঝটিকা মিছিল বের করার পর তারা ফেসবুকে পোস্ট করে। এর সূত্র ধরে তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের অভিমত সুনির্দিষ্ট ভাবে যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত, তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে। সারাদেশ কেন, বিশ্লেষকদের দাবি এক মোহাম্মদপুর এলাকা ১০ মাসে স্বাভাবিক করা যায়নি। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে গ্রেপ্তারের সংখ্যা বড় বিষয় নয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিশৃঙ্খলা তৈরিসহ বিভিন্ন অপরাধে যারা যুক্ত, তারা ধরা পড়ছে কিনা সেটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, আমরা এখনও দেখছি, মব সৃষ্টি করে কারও কারও কাছ থেকে বৈধতা পাওয়া যাচ্ছে। যদি অভিযান বা গ্রেপ্তার শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হয়, তাহলে সামগ্রিক ভাবে তা পরিস্থিতি উন্নতিতে কোনো কাজে আসে না। উল্লেখ্য দেশের কারাগারের ৫৭টি কারাগার আছে। প্রসঙ্গগত দেখা যায়, অধিকাংশ কারাগারের ধারন ক্ষমতার বেশি বন্দি আটক অবস্থায় আছে। কোনো কোনো কারাগারের ধারন ক্ষমতার ২ / ৩ গুণ বন্দি আছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার গণমাধ্যমকে বলেন, তাদের কারাগারে বন্দি ধারন ক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০ জন। তবে সাম্প্রতিক মাস গুলোয় গড়ে আট হাজারের মতো বন্দি থাকছেন। সর্বশেষ গত শনিবার এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ২০০। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে আমি দায়িত্ব নেওয়ার সময় এখানে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বন্দি ছিলেন। পরে তা বেড়ে যায়। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ জন নতুন বন্দি কারাগারে যুক্ত হন। প্রায় সমান সংখ্যক জামিনে মুক্ত হন। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ইকবাল হোসেন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দির ধারন ক্ষমতা ২ হাজার ২৪৯ জনের। এখন আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো। প্রতিদিন গড়ে ১০০ জনের জামিননামা আসে। আর নতুন বন্দি ঢোকে গড়ে ১০০ বেশি। একই ধরনের চিত্র বাংলাদেশের সকল কারাগারের। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত সরকারে পরে রাজনৈতিক চাপ বাড়লে গ্রেপ্তার বাড়ে। উল্লেখ্য গত ৮ মে গভীর রাতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর হয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ড যান সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। এতে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। একে কেন্দ্র করে তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দল।
পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, এ সময় সারাদেশে অভিযান জোরদার হয়। ৯ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি লোক গ্রেপ্তার হয়। এর মধ্যে ১০ মে এক দিনেই গ্রেপ্তার হয় ২ হাজার ২৭১ জন। ১২ মে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান আরও জোরালো হয়। দলটির সাবেক সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার চলছে। এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ৮৭ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। গতকাল পর্যন্ত ধরলে মে মাসে গ্রপ্তার ৪৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। গত ১৯ এপ্রিল রাজধানীর বিমান বন্দর থানা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে: জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ যেন মিছিল বা সভা-সমাবেশ করতে না পারে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। গত এক মাসে শুধু ঢাকাতেই আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী, ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের অন্তত ২৩৬ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চলমান অভিযানে গ্রেপ্তার ১৪ হাজার ২৬৬ করা হয়। ঢাকা সেনানিবাসে গত ২৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গত ৪০ দিনে সেনাবাহিনী ২৪১টি অবৈধ অস্ত্র ও ৭০৯ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। গত আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত সর্বমোট ৯ হাজার ৬১১টি অবৈধ অস্ত্র ও ২ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। গত এক মাসে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ১ হাজার ৯৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ২৬৬ জন গ্রেপ্তার হয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে।