সম্পাদকীয়
দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর ইতোমধ্যে পঁচাত্তর বছর অতিক্রম করেছে। সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, দেশের জন্য দলটির ভূমিকা এবং অবদান অনস্বীকার্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও ডাকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। সত্তরের জাতীয় নির্বাচন পর্বে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এই ভূখণ্ডে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের নজির যে প্রেক্ষাপটে সৃষ্টি করেছিল তাও ইতিহাসের অক্ষয় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও দলের সভা নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলের ভেতর-বাহির থেকে আত্মজিজ্ঞাসা একই সঙ্গে আত্মসংশোধনের তাগিদ উঠে আসছে।
সাম্প্রতিক সহিংসতায় হতাহত ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়া ব্যতিরেকেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আওয়ামী লীগকে ইতোমধ্যে কম অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিশ্লেষক ও আওয়ামী লীগের দুর্দিনের বন্ধুরাও প্রশ্ন তুলেছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনকে সহিংস করে তোলার সুযোগ যারা নিয়েছেন রাজনৈতিক দক্ষতা-দূরদর্শিতা-প্রজ্ঞা কিংবা বিচক্ষণতা দিয়ে আওয়ামী লীগ কেন তাদের প্রতিহত করতে পারল না? এক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে ক্ষোভ।
আমরা দেখেছি, আন্দোলন চলাকালে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কেউ কেউ এমন বক্তব্য রেখেছেন, যা আগুনে ঘৃতাহুতির শামিল। আমরা নিকট অতীতেও বলেছি, যা ঘটে গেছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং মর্মবেদনার। বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমরা এও দেখছি, দলটির নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই আত্মোপলব্ধির বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এই সংগঠনটি বিগত কয়েক বছর ধরে ফিরে ফিরে নেতিবাচক অর্থে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। সর্বসাম্প্রতিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে তাদের ভূমিকা নিয়েও জনপরিসরে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। একই সঙ্গে নানা মহল থেকে তো বটেই এমনকি সংবাদমাধ্যমেও নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, ছাত্রলীগের অবিমৃশ্যকারিতায় পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। আমরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কাছে কোনোভাবেই দেশ-জাতির জন্য বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করেএমন কিছু প্রত্যাশা করি না। বিশেষ করে কোনো দল টানা সরকারে থাকলে তাদের প্রতি জনপ্রত্যাশা বেশিই থাকে।
অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি-উত্তর এখন পর্যন্ত দেশের যে চিত্র দৃশ্যমান বিষয়গুলো জাতীয় ভাবমূর্তির প্রশ্ন সামনে এনেছে। এটা অনভিপ্রেত-অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক। আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগ কোনো ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল বা সংগঠন নয়। অথচ দল কিংবা সংগঠনের কারও কারও ভুলের দায় সামগ্রিকভাবে দলটির ওপরই পড়েছে। আমরা মনে করি, যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনা আত্মশুদ্ধির পথ বাতলে দেয়। আমরা এও বিশ্বাস করি, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের সৌন্দর্যেরই শোভা বর্ধন করে। কেউ যদি এই জিজ্ঞাসা কিংবা সমালোচনায় উষ্মা প্রকাশ করেন এসব আমলে নিয়ে নিজেদের ভুলত্রুটি সংশোধনের পথ অনুসন্ধান না করেন তাহলে তা তাদের জন্যই বুমেরাং এমন নজির দূর অতীতে তো বটেই; ৫৩ বছরের বাংলাদেশেও কম নেই। ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউই নন। এই প্রেক্ষাপটে সমালোচনা সহ্য করার এবং আগামীর জন্য দল গুছানোর পাশাপাশি সমালোচনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার মানসিকতা উর্বর করতে হবে ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটিকে।